আমাদের দেশে এক সময় খাবারের যথেষ্ট অভাব ছিল। এখন আর তেমন অভাব নেই। এজন্য প্রথমেই দেশের অগণিত কৃষকদের অবদানের কথা স্মরণ করতে হয়। আর এই কৃষকদের পেছনে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ কিছু কৃষিবিজ্ঞানী। কাজী এম বদরুদ্দোজা তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে (পরবর্তীকালে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর একই প্রতিষ্ঠানে মাইকোলজি (ছত্রাক বিদ্যা) বিষয়ে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। ইতোমধ্যে অ্যাগ্রিকালচারাল বোটানিতে প্রথম শ্রেণি পেয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
অতঃপর ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইকোলজির পরীক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সুযোগ পান। ১৯৫৭ সালে প্লান্ট প্যাথলজিতে (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব) পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে এসে ঢাকার কৃষি গবেষণা খামারে ইকোনোমিক বোটানিস্ট হিসেবে তার পেশা শুরু করেন।
কর্মরত অবস্থায় ১৯৬০ সালে তিনি সুইডেনের লান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কৌলিতত্ত্বে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। এর পরপরই পোস্ট-ডক্টরেট স্কলার হিসেবে আবারও সুইডেনের একই ইউনিভার্সিটিতে ১৯৬০ থেকে ১৯৬১; এই দুই বছরের জন্য গবেষণা করার সুযোগ পান। এর কয়েক বছর পরে পাকিস্তান কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (গবেষণা) হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তার কর্মকাল ছিল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকরা গম এবং ভুট্টা ফসলের সাথে খুব একটা পরিচিত ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষকদের কাছ গম ও ভুট্টা পরিচিত ফসল হলেও সেগুলোর ফলন আশানুরূপ ছিল না। সেই সময় আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. নরম্যান বোরলগ খাদ্য সঙ্কটে জর্জরিত তৎকালীন পাকিস্তান ও ভারতে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও রোগ প্রতিরোধী গমের জাত প্রচলনের সম্ভাবনা নিয়ে কাজের সুযোগ খুঁজছিলেন। তখনই পাকিস্তান থেকে ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা এবং ভারত থেকে ড. মনকম্ভু সম্বাশিবন স্বামীনাথন তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশেরই গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে যায়। পাকিস্তান (মূলত পশ্চিম পাকিস্তান) গমে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও সেই সময় থেকে গমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
উপমহাদেশে সবুজ বিপ্লবের শুরু এভাবেই। এর শুরুটা ড. বোরলগের হাত দিয়ে মেক্সিকো থেকে। পরে ক্ষুধা-নিপীড়িত সারা পৃথিবীতে এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। তাই ড. বোরলগকে সবুজবিপ্লবের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭০ সালে তাকে শান্তিতে নবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সেই নীরিখে ড. স্বামীনাথনকে ভারতে সবুজ বিপ্লবের জনক বলে অভিহিত করা হয় । একইভাবে ড. বদরুদ্দোজাও পাকিস্তানের পক্ষে সবুজ বিপ্লবের অগ্রনায়ক ছিলেন। এই কাজের পাশাপশি তিনি পাকিস্তানে বেসরকারি পর্যায়ে একটি ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। উন্নয়নশীল বিশ্বে এ ধরনের উদ্যোগে তিনি প্রথম এগিয়ে আসেন। ফলে পাকিস্তান ভুট্টার তেল, স্টার্চ, কর্ন-সিরাপ এবং কর্ন-ফ্লেক উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে।
বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম চলাকালে তিনি পাকিস্তান কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তারপরে তাকে আরও সব বাঙালি সরকারি চাকুরেদের সাথে এক রাজনৈতিক বন্দি শিবিরে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। দেশে ফিরে আসার ছয় মাস পর তাকে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে তাকে কৃষি (গবেষণা ও শিক্ষা) বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। স্বাধীনতার পর ভঙ্গুর অর্থনীতি ও তীব্র খাদ্য ঘাটতির দেশে তারা প্রথম কাজ ছিল অস্থির কৃষি গবেষণা-ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। নতুন দেশের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালে তিনি স্বশাসিত কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার অনুমতি আদায়ে সক্ষম হন। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে তার প্রত্যক্ষ তদারকি ছিল। ১৯৭৬ সালে তারই প্রচেষ্টায় পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (বর্তমানের মহাপরিচালক) হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিএআরআইয়ের দায়িত্ব ছাড়াও ১৯৭৮ সালে ড. বদরুদ্দোজাকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যানের (বর্তমানে নির্বাহী চেয়ারম্যানের) দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমস্ত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের ছত্রধারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএআরসি তখনও প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিএআরসি আজকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের প্রধান নির্বাহী হিসেবে ড. বদরুদ্দোজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তার হস্তক্ষেপ ছাড়া বিআইএনএ আজকের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারতো না।
১৯৭০-৭১ সালে দেশে গমের আওতায় আবাদি জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ০.১৩ মিলিয়ন হেক্টর এবং মোট উৎপাদিত গমের পরিমাণ ছিল ১.১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ছিল মাত্র ০.৮৭ টন। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে ০.৩২ মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে মোট উৎপাদিত গমের পরিমাণ ছিল ১.১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ১৯৭০-৭১ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত যথাক্রমে গমের আবাদ-এলাকা, মোট উৎপাদন ও ফলন বেড়েছে যথাক্রমে ৩, ১০ এবং ৪ গুণ। তারপরেও দেশের মোট চাহিদার মাত্র বিশ শতাংশ দেশে উৎপাদিত গম দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। গমের কারণে আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতি অনেকটাই বদলে গেছে। যদিও আবহাওয়গত কারণে গমের আবাদি এলাকা এখন তেমন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
সোয়াবিন বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অজানা একটি ফসল ছিল। ড. বদরুদ্দোজা বিএআরসি-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে উফশী সোয়াবিনের গবেষণা ও সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেন। সমন্বিত এই প্রকল্পের সাথে অন্যতম প্রতিষ্ঠান গুলো হলো: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পী ফুড প্রোডাক্টস, মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতাদি। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোয়াবিন উৎপাদন করে গবাদিপশু এবং মানুষের জন্য প্রোটিনের জোগান বাড়ানো। এর ফলশ্রুতিতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে নোয়াখালী ও ভোলায় সোয়াবিন একটি উল্লেখযোগ্য ফসল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) শুরু থেকেই দেশের বৃহত্তম বহুবিধ ফসল গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি দানাশস্য (চীনা, কাউন), কন্দাল, ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফল, মসলা, ফুল ইত্যাদির উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন বিষয়ে গবেষণা করে থাকে। সাম্প্রতিককালে গম ও ভুট্টা গবেষণার জন্য আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলেও তার যাত্রা শুরু বিএআরআই এর ছত্রছায়ায়। অবশ্য ধান, পাট, ইক্ষু এবং তুলা নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই ছিল। বিএআরআই মৃত্তিকা এবং শস্য ব্যবস্থাপনা, রোগ বালাই এবং পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, পানি এবং সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন, খামার পদ্ধতির উন্নয়ন, শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং আর্থ-সামাজিক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে থাকে।
বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন থেকে ১৯৮৫ সালে অবসরে গেলেও আমৃত্যু তিনি কৃষির উন্নয়নে সক্রিয় ছিলেন। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১২ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘স্বাধীনতা দিবস‘ পদকে ভূষিত করে। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান তাকে বিভিন্ন সময়ে সম্মানিত করেছিল।
ড. বদরুদ্দোজা ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট ৯৬ বছর বয়সে ঢাকায় মারা যান। তার পেশাগত জীবনের শুরু একজন সাদামাটা গবেষক হিসেবে। তখন দেশে কৃষি গবেষণার অবকাঠামো বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সেই দুঃসময়ে দেশে থেকে পুরো কৃষি গবেষণা কাঠামোকে দাঁড় করাতে তিনি গবেষণা-ব্যবস্থাপক হিসেবে যে ভূমিকা রেখে গিয়েছেন তা বর্ণনার অতীত।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]