বাংলাদেশে কৃষি এবং কৃষক যে সমাজে বৈষম্যের স্বীকার, সে কথা বলতে খুব শক্ত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। একটা সহজ উদহরণ হলো, কৃষিপণ্যের কৃষকের মাঠে বাজারমূল্যের তুলনায় এর উৎপাদন খরচের ফারাক। আরেকটি বঞ্চনার সহজ উদাহরণ হলো কৃষক তার পণ্যটি বিক্রি করে যা পায়, সে তুলনায় ভোক্তা পর্যায়ে এর মূল্যের বিরাট ফারাক। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ মূল্য বৃদ্ধির ফারাক থেকে কৃষক কোনো অংশ পায় না, যে ব্যবস্থাটিকে আমরা কখনও চ্যালেঞ্জ করতে চাই না।
এখানে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বোঝা জরুরি সেটি হলো, আমরা আসলে কোন ধরনের কৃষকের কথা বলছি। আমরা বলছি বাংলাদেশের সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রেণির কৃষকের কথা, যারা মূলত ক্ষুদ্র কৃষক বা বর্গা চাষি। বর্গাচাষ প্রথা না থাকলেও তাদের বর্গাচাষি বলতে হচ্ছে– কারণ গ্রাম এলাকায় এখন যে ব্যাপক আকারে ভূমিহীন শ্রমজীবী মানুষ কৃষিকে প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের বোঝার জন্য কোনো জুঁতসই নাম এখনও আমরা জানি না। তারা একই সঙ্গে কৃষক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশা/ভ্যান শ্রমিক, যখন যে কাজ মেলে শহরে বা গ্রামে তাই করে। এ শ্রেণির কৃষকের প্রধান পুঁজি তাদের শ্রম। তার শ্রম, তার বাড়ির মেয়েদের শ্রম, শিশুদের শ্রম, বাবা-মায়েদের শ্রম। এ ধরনের কৃষককে অবশ্যই ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষক বলা যায়।
তাদের সংজ্ঞায়ন দরকার এবং কী কারণে তাদের বিষয়ে আলাদা আলোচনা করা দরকার এবং কী কারণে অন্যান্য কৃষক শ্রেণি থেকে তারা আলাদা, সে বিষয়টিও আলোচনার দরকার আছে এবং করা যাবে। আলোচনাটি আরও গুরুত্বপূণ, কারণ একই সময়ে কৃষকদের এ শ্রেণিটি সর্ববৃহৎ ভোক্তা জনগোষ্ঠী। ধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ যে পণ্যটি তারা উৎপাদন করছে, সেটিই বিক্রির কিছু মাস পরে তা তারা অনেক বেশি মূল্যে বাজার থেকে কিনে খাচ্ছে। নিজেরাই নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখছে; কিন্তু যেহেতু তারা তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় তারা ব্যাপকভাবে শোষণের শিকার হচ্ছে।
ধান উৎপাদনের এই শ্রমঘন এবং আপাত লাভহীন কাজটি তারা কেন করছেন, সে প্রশ্নটি আমরা করতেই পারি। এ বিষয়ে আমাদের গবেষণায় হয়তো গভীর কারণগুলো বোঝা যাবে। কিন্তু সহজে যে কারণটি আমরা বুঝে নিতে পারি তা হলো, এর চেয়ে ভালো কোনো কাজের অভাবে তারা এ কাজটি করছেন। এখানে হয়তো তাদের এ কাজে বড় কোনো প্রতিবন্ধিতা নেই। মোটামুটি সহজে করতে পারছেন, কারণ বাজারে জমির সরবরাহ আছে, যদিও হয়তো জমি পত্তন পাওয়ার ক্ষেত্রে এর শর্তগুলো দিন দিন তাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ধান চাষ উপযোগী জমি, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে বিনা সেচ খরচে চাষ উপযোগী জমি একটি বড় দান আমাদের জন্য। সবচেয়ে বড় যে কারণ সেটি হলো, বাজারে অন্যান্য ফসলের তুলনায় ধানের দামের নিশ্চয়তা। বাজারের ওপর এ কৃষকদের কোনো চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকলেও অন্যান্য যে কোনো পণ্যের তুলনায় এ ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম পুঁজি উঠে আসার নিশ্চয়তা থাকে।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আমরা জানি ধান উৎপাদন কৃষকের জন্য লাভজনক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতির। তার পরও তারা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকরা ধান উৎপাদন করছেন। কারণ এ ক্ষেত্রে অন্য ফসলের তুলনায় সার্বিক ঝুঁকি কম, সম্পূর্ণ পুঁজি হারানোর ঝুঁকি কম।
এ শ্রেণির কৃষকের প্রধান কৃষিকাজ হলো ধানচাষ। আর ধান, চাল বা খাদ্য উৎপাদন কাজ হলো বাংলাদেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে প্রধানতম কাজ। আমরা এ কথাও জানি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা অর্জনের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই সবচেয়ে কঠিন কাজটি করতে হচ্ছে দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক শ্রেণিটিকে।
এই যে প্রান্তিক শ্রেণিটি এ কাজটি করছেন, অনেকটা তাদের জীবন-জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে, সংগ্রাম জারি রাখতে, তারা কিন্তু জানেন না, তাদের এ কাজের মাধ্যমে তাদের অজান্তেই দেশের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছেন এবং তারা তা করছেন দেশের শাসক শ্রেণি বা জনগণের পক্ষ থেকে ন্যূনতম কোনো রকম স্বীকৃতি বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়াই।
কোনো কোনো দুর্যোগের সময় আমাদের নাগরিক সমাজের কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কথা বলি। যেমন– স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বা পরে, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, ২০০৭-০৮ সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত সংকট, করনাকাল ২০১৯-২২ এবং বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কিংবা রাজনৈতিক বড় কোনো দুর্যোগে। কথা বলি; কিন্তু সে কথার কোনো প্রকাশ দেখি না আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়নে বা সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ায়। সব ভুলে যাই দুর্যোগের কয়েক দিন পরেই।
অথচ অন্য অনেক শ্রেণির জন্য আমরা অনেক কিছুই করি। বঞ্চিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দ্রুতগতিতে প্রমোশন দিই, ব্যবসায়ীদের নানারকম ভর্তুকি দিই, কিছু ক্ষেত্রে শহরের মানুষের জন্য কিছু সুবিধা, কিছু বিশেষ বাহিনীর জন্য সুবিধাদি এবং বিশেষ প্রশংসা বাণী ইত্যাদি ইত্যাদি আমরা বেশ নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছি। কিন্তু এ কথা সত্যি, ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য চোখে পড়ার মতো তাৎক্ষণিক কোনো সহায়তা করা হয়েছে– এমন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের উদাহরণ নেই বললেই চলে।
আমাদের গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে এই প্রান্তিক কৃষক শ্রেণির জন্য আমাদের সুদূরপ্রসারী কী কী কাজ করা দরকার সে সম্পর্কে। প্রথমত, তাদের সংগঠিত করা, তাদের জন্য সহজে উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, তাদের পণ্যের বাজারমূল্য নিশ্চিত করা, তাদের জন্য বাজার ব্যবস্থা পরিগঠন করা, বাজারভিত্তিক যৌথ সেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের জন্য কৃষিযন্ত্রের সেবা নিশ্চিত করা, এই শ্রেণির কৃষক উপযোগী প্রশিক্ষণ, জ্ঞান, তথ্যসেবা, পরিকল্পনা সহায়তা প্রদান, সহজ পুঁজি সরবরাহ ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, কৃষির বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত গবেষণা এবং সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং সমাধান করার চেষ্টা কোনো বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারবে না। আমাদের দরকার সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। আমাদের এ ধরনের কাজে সাফল্য পেয়েছে– এমন অনেক দেশ এবং ব্যবস্থা থেকে শিখতে হবে। সঙ্গে এ কথাও ভাবতে হবে যে, কৃষির এ বিশেষ শ্রেণিকে সহায়তা করতে আর কোন কোন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। সেগুলোকেও আমাদের বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে এবং সমাধান করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সম্পদের বিন্যাস করতে হবে এবং এটিকে সফল করতে একটি যোগ্য নেতৃত্ব দরকার হবে।
আহমাদ সালাহুদ্দীন: উন্নয়ন গবেষক
ahmad.salahuddin48@gmail.com