
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ শিকারের হিড়িক পড়েছে। ফাঁদ পেতে আর বিষটোপ দিয়ে হরিণ শিকার করা হচ্ছে। শিকারিচক্র রীতিমতো হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে। সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে দীর্ঘদিন ধরে হরিণ শিকারিচক্র গড়ে উঠেছে। শিকারিদের ফাঁদে আটক হওয়ার পর সুন্দরবনের ভেতরেই হরিণ হত্যা করা হয়। এরপর খণ্ড খণ্ড করে মাংস প্রস্তুত করে বিক্রি করার জন্য লোকালয়ে আনা হচ্ছে। ধরা না পড়লে জানার উপায় নেই সুন্দরবনে কী পরিমাণ হরিণ নিধন হচ্ছে।
গত তিন মাসে সুন্দরবন বিভাগ ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে ৬৪১ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করেছেন।
এ সময় শিকারিদের কাছ থেকে হরিণের মাথা, চামড়া, মৃত হরিণ, হরিণের পা, ফাঁদ এবং নৌকা ও ট্রলার জব্দ করা হয়। হাতেনাতে ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে হরিণের মাংস জব্দ এবং শিকারিচক্রের সদস্যরা আটক হলেও থামছে না হরিণ শিকার। এভাবে হরিণ শিকার চলতে থাকলে সুন্দরবন একসময় হরিণসংকটে পড়তে পারে।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, হরিণ শিকার রোধ করতে হলে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে এবং শিকারিদের চিহ্নিত করে তাদের বিকল্প পেশায় ফেরাতে হবে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনে বাঘ শিকারের চেয়েও হরিণ শিকার ভয়ংকর। বাঘের প্রধান খাবার হরিণ। তাই হরিণ না থাকলে সুন্দরবনে বাঘ থাকবে না।
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ এবং মোংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পৃথক অভিযান চালিয়ে ৬৪১ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, একটি মৃত হরিণ, হরিণের দুটি চামড়া, দুটি মাথা, আটটি পা, চারটি ট্রলার, পাঁচটি নৌকা, ১৬০টি ফাঁদ, একটি মাইক্রোবাস, সাতটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলাধীন সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলা গ্রামের জেলে ও কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্রুপের (সিপিজি) সদস্য জামাল গাজীর তথ্য মতে, শরণখোলা উপজেলায় প্রায় ১০০ জন হরিণ শিকারি রয়েছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি হরিণ শিকারিচক্রের সঙ্গে জড়িত। শিকারিরা অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে ফাঁদ পেতে হরিণ আটক করছে। এরপর সুন্দরবনের মধ্যে হরিণ জবাই করে মাংস প্রস্তুত করে বিক্রির জন্য লোকালয়ে নিয়ে আসে। এভাবে হরিণ শিকার চলতে থাকলে একসময় সুন্দরবনে হরিণসংকট তৈরি হবে।
শিকারিদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামাল গাজী জানান, বিভিন্ন সময় তিনি নিজে শিকারিদের সঙ্গে কথা বলে সুন্দরবনে হরিণ শিকার না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এতে শিকারিরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি দিয়েছে।
জামাল গাজী আরো জানান, সুন্দরবনে হরিণ শিকার বন্ধ করতে হলে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে তালিকা করে তাদের বিকল্প পেশায় যুক্ত করা গেলে হরিণ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম জানান, হরিণ শিকার ঠেকাতে বন বিভাগের সদস্যরা সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। বন বিভাগের কেউ শিকারিদের সঙ্গে আপস করবে না। বন বিভাগের টহলের পাশাপাশি স্মার্ট প্যাট্রলিং বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপ, চাঁদপাই, শরণখোলা, মোংলাসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট বন বিভাগের নজরদারিতে রয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান জানান, হরিণ শিকার ঠেকাতে সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে সন্দেহজনক নৌকা বা ট্রলারে তল্লাশি করা হয়। শিকারিদের ধরতে বিভিন্ন সময় বনে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বনের বিভিন্ন পয়েন্টে বন বিভাগের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামের মানুষকে সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে হরিণ বাঘের খাবার, নিজেরা হরিণ খাব না। হরিণের মাংসের চাহিদা বন্ধ করতে হবে। চাহিদা বন্ধ করা না গেলে সরবরাহ বন্ধ হবে না। রাজধানী ঢাকায়ও হরিণের মাংস পাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে এত পথ অতিক্রম করে কিভাবে যে ঢাকায় হরিণের মাংস পৌঁছে যায়, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এ অবস্থায় ‘হরিণের মাংসকে না বলি’—এমন স্লোগান বাস্তবায়ন করা জরুরি।” সূত্র: কালেরকণ্ঠ
এগ্রি২৪.টিভির বিদেশ, জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হতে আগ্রহীরা সিভি ও নিউজ পাঠান agri24.tv@gmail.com এই ইমেইলে