জলবায়ু পরিবর্তন মানব অস্তিত্ব ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য, উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী উৎসাহ দেখা গেলেও ভিত্তিগত সমাধান নিয়ে খানিকটা নিরুৎসাহই দৃষ্টিগোচর হয়। তবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই মানবসৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় দুই দশক ধরে কার্বন নিঃসরণ ও গ্রিনহাউস ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী মিথেন নিরসনে একটি কার্যকর ছত্রাক আবিষ্কার করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনে মুখ্যত দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন-গ্লোবাল ওয়ার্মিং। মানুষ দুই হাজার বছর ধরে শিল্প, কৃষি ও চিকিৎসায় প্রচুর কয়লা ও বর্জ্য পুড়িয়ে এবং পশুপালনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন ছড়িয়েছে, তা উষ্ণায়নের জন্ম দিয়েছে। বন্যা, খরা, মেরুপ্রান্তে বরফ গলন থেকেই সৃষ্ট প্রকৃতির অসুখ! গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সঙ্গে গ্রিনহাউস ইফেক্ট অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। গ্রিনহাউস ইফেক্টই প্রকৃতিতে প্রাণিজগতের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভুমিকা পালন করছে। এর কারণেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে; অন্যথায় সেটা হতো ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গ্রিনহাউস ইফেক্ট কীভাবে কাজ করে? কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ও ফ্লোরিনেটেড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে গ্লাসের মতো আবরণী তৈরি করে। এই বায়ুমণ্ডলের ভেতর তাপ আটকা পড়ে যায়। এভাবে বছরের পর বছর আটকে পড়া তাপের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে ৮০ শতাংশই কার্বন ডাই-অক্সাইড, ১০ ভাগ মিথেন, ৭ ভাগ নাইট্রাস অক্সাইড ও ৩ ভাগ অন্যান্য। এর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ১০০ বছর এবং নাইট্রাস অক্সাইড ১১৪ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রিনহাউস ইফেক্ট নিয়ে ভয় কেন? ইউরোপিয়ান কমিশনের ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট হাইলাইট’ রিপোর্টে উঠে এসেছে, ২০২৪ সালে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস; ২০২৩ সালের গড় তাপমাত্রা থেকে ০.১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রার গড় বৃদ্ধি প্রায় ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সত্যিই ভীতিকর। শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ, কিন্তু মিথেন বেড়েছে প্রায় ১৬৫ শতাংশ। কাজেই কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন অনেক বড় প্রভাবক। উল্লেখ্য, প্রতি ১০০ বছরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৮ গুণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষমতা রাখে মিথেন। যদিও অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ী, মিথেন অন্য যৌগের সঙ্গে বিক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। এসব কারণেই মিথেনের মাত্রা বৃদ্ধি জীবজগতের জন্য রেড অ্যালার্ট।
বাংলাদেশের মূল অর্থনৈতিক সহায়ক কৃষি, পশুপালন, উভয় ক্ষেত্রই মিথেন নিঃসরণে জড়িত। কৃষিকাজ থেকে প্রতিবছর ৮৩.৫৬ মিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। পশুপালন থেকে নির্গত মিথেনের পরিমাণের অবশ্য হিসাব পাওয়া যায় না। তবে ২০২২-২৩ সালের পরিসংখ্যানমতে, দেশে প্রায় আড়াই কোটি গরু ও ২ কোটি ৭০ লাখ ছাগল রয়েছে।
আমরা জানি, গরু-ছাগলের মতো গবাদি পশু সারাদিনে ঘাস-পাতা যা-ই খায়, প্রথমে জমা হয় পাকস্থলীর জাবর থলিতে। সেখানে আংশিক গাঁজন প্রক্রিয়ায় অর্ধপাচিত গলিত মণ্ড তৈরি হয়। এ সময় উপজাত হিসেবে তৈরি হয় মিথেন গ্যাস, যা পরে মুখ দিয়ে বের হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়।
মিথেনের এই বৃহৎ উৎস নিয়ন্ত্রণে অনেক গবেষণা চলছে। এর মধ্যে ‘অ্যাসপেরোগোপসিস টেক্সোফরমিস’ নামের সামুদ্রিক শৈবাল মিথেন নিরোধক প্রমাণ হয়। এই শৈবালের যৌগ ‘ব্রোমোফর্ম’ মিথেন উৎপাদনে বাধা দেয় এবং গরুর স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক উপকারী যৌগ তৈরিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। শৈবালটি গরুর খাবারে দিলে তা প্রায় ৯৮ শতাংশ মিথেন উৎপাদন কমিয়ে আনতে সক্ষম।
মুশকিল হলো, এই শৈবালে অল্প পরিমাণে ব্রোমোফর্ম প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়; গভীর সমুদ্রে বিশেষ ঋতুতে ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জন্মায় বলে এটি সংগ্রহ বা চাষাবাদও দুরূহ। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সম্প্রতি ড. আবেদ চৌধুরী নতুন এক ফাঙ্গাল স্ট্রেইনের কথা বলেছেন। ‘কার্ভুলারিয়া এসপি ৪৩৮৮’ নামে ছত্রাকটির মিথেনকে অকার্যকর করার ক্ষমতা সেই সামুদ্রিক শৈবালের চেয়েও কয়েক গুণ। ছত্রাকটি খাবার বা পানির সঙ্গে গরুকে খাওয়ালে মিথেন উৎপাদন শতভাগ থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। ছত্রাকগুলো সহজেই জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আরও কার্যকর করে তোলা সম্ভব। ছত্রাক মিশ্রিত খাবার প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহ করা গেলে একদিকে যেমন পরিবেশ থেকে মিথেন কমিয়ে আনবে, অন্যদিকে গরুর স্বাস্থ্য ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে পশুপালন ব্যবস্থা এখনও দুর্বল ও ভঙ্গুর। গ্রামীণ পর্যায়ে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এ জন্য সহজে বোধগম্য, সুসাধ্য ও ঝুঁকিমুক্ত এই পদ্ধতি পশুপালনে মিথেন হ্রাসে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রাসায়নিক পদার্থ বা মেকানিক্যাল যন্ত্র ব্যবহার ছাড়াই ছত্রাকের মাধ্যমে মিথেনের উৎপাদন হ্রাসের এই পদ্ধতি শুধু আমাদের দেশে নয়; বরং গোটা বিশ্বেই পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই উদ্ভাবন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশবান্ধব কৃষি ও নগরায়ণ এবং শিল্পায়নে গোটা বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, পরিবেশবান্ধব খামার বাস্তবায়নে ড. আবেদ চৌধুরীর এই আবিষ্কার আমাদের ভবিষ্যতে সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।
আলকাতুজ্জাকিয়া আঁখি: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ