গ্রামবাংলার বহু খামারি ভাবেন, ছাগলগুলো যদি আরেকটু বেশি মাংস দিত! সংসারটা একটু ভালো চলত। অন্যদিকে নারকেলবাগানের মালিকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। ‘গাছগুলো ঠিকমতো ফল দিচ্ছে না। কী যেন এক পোকা সব ফলন নষ্ট করে দিচ্ছে। কী করি?’
কৃষকের এমন সব সমস্যারই সমাধান খোঁজেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকেরা। দেশের কৃষি ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে সারা বছর কাজ করে ময়মনসিংহে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের দল। সম্প্রতি দুটি গবেষণায় তাঁরা ছাগলের একটি উচ্চ উৎপাদনশীল সংকর জাত উদ্ভাবন করেছেন, শনাক্ত করেছেন নারকেলগাছের জন্য ক্ষতিকারক সাদা মাছির একটি নতুন প্রজাতি। সূত্র: প্রথম আলো
বাড়বে মাংসের উৎপাদন
দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল ও দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার জাতের ছাগলের সংকরায়ন করে ছাগলের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে বাকৃবির একদল গবেষক। গবেষক জানান, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, জাতটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মতো সহজেই লালন-পালন করা যায়। লালনপালন খরচ সমান হলেও নতুন এই জাতের বৃদ্ধি ব্ল্যাক বেঙ্গলের প্রায় দ্বিগুণ—পুরুষ ছাগল বছরে ২৬ কেজি ও স্ত্রী ছাগল ২৩ কেজি মাংস উৎপাদনে সক্ষম।
বছরে গড়ে পাঁচটি বাচ্চা দেয় একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল। নতুন জাতেও এই বৈশিষ্ট্য বজায় থাকবে। প্রতিটি বাচ্চা প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে। এতে এক বছরে একজন খামারি পাঁচটি বাচ্চা থেকে আয় করতে পারবেন প্রায় এক লাখ টাকা। অন্যদিকে, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চা থেকে বছরে সর্বোচ্চ আয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে। পাঁচটি বাচ্চা থেকে বছরে আয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। ফলে নতুন জাতটি খামারিদের জন্য বছরে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত লাভের সুযোগ তৈরি করবে।
গবেষক আরও জানান, সংকর জাতের বাচ্চার ওজন ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের বাচ্চার ওজনের দ্বিগুণেরও বেশি। চামড়ার রং সাদা, কালো, বাদামি হওয়ায় এ জাতের ছাগল দেখতেও সুন্দর। সংকর জাতটির জিনে ৫০ শতাংশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ও ৫০ শতাংশ বোয়ার জাতের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের তুলনায় এগুলোর প্রজনন ক্ষমতা বেশি, মাংসের স্বাদও ভালো।
তবে একটি বিষয়ে সতর্কও করলেন গবেষক রুহুল আমিন, এই সংকর জাতকে প্রথম প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মে ব্ল্যাক বেঙ্গলের বৈশিষ্ট্য কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ব্ল্যাক বেঙ্গলের বৈশিষ্ট্য কমে গেলে জাতটি আর দেশের আবহাওয়া উপযোগী থাকবে না। তা-ও এই সংকর প্রজাতিকে ব্রয়লার মুরগির মতো টার্মিনাল প্রোডাক্ট (শুধু মাংস উৎপাদনের জন্য পালিত প্রাণী) হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। প্রজননের জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ও বোয়ার জাতের ক্রস ব্রিডিং পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলেই সংকর ছাগলকে মাংস সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে।
সাদা মাছির বিপদ
২০১৯ সালে ‘নারকেলের সাদা মাছি’ নামে পরিচিত একটি পোকা শনাক্ত হয়েছিল। বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক গোপাল দাসের নেতৃত্বে একদল গবেষক এবার সাদা মাছির নতুন একটা প্রজাতি শনাক্ত করেছে। প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম প্যারালেইরোডেস বোন্দারি, যাকে বলা হচ্ছে ‘বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছি’। যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের নারকেলগাছে এই মাছির উপস্থিতি পেয়েছেন গোপাল দাসের দল।
এই মাছি নারকেলগাছের মারাত্মক ক্ষতি করছে বলে জানালেন তিনি। বললেন, নতুন এই সাদা মাছি আকারে ছোট (দৈর্ঘ্য ১.১-১.২ মিলিমিটার)। পাখায় কাটা চিহ্ন থাকে, যা এই মাছি চেনার অন্যতম পন্থা। প্রচলিত অন্যান্য সাদা মাছির চেয়ে এদের প্রজননক্ষমতা ও ডিম পাড়ার হার বেশি। পাতার নিচে তুলার মতো একটি বাসা তৈরি করে এরা ডিম পাড়ে, যা অন্য সাদা মাছির চেয়ে আলাদা। ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে এই পোকাটি ইতিমধ্যে নারকেলগাছের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু একই রকম হওয়ায় এখানেও ক্ষতির ঝুঁকি বেশি। এই নতুন মাছি নারকেলের ফলন কমিয়ে দিতে পারে এবং পুরো শিল্পে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
তাই নতুন পোকাটি নিয়ে চলছে উচ্চতর গবেষণা। এর প্রজননক্ষমতা, ক্ষতির ধরন ও নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত জানার লক্ষ্যে কাজ করছে গবেষক দল। পাশাপাশি এই মাছির হাত থেকে বাঁচার কিছু পথও বাতলেছেন তাঁরা। যেমন নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে জৈব-বালাইনাশক ব্যবহার, উপকারী পোকা সংরক্ষণ ইত্যাদি।