মুরগির সরবরাহ বাড়াতে নতুন বিপ্লব এনেছে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক পোল্ট্রি খামার।’ বিনা পুঁজিতে নিশ্চিত লাভের এ ব্যবসা মুরগির খামারিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ক্রমবিকাশমান এ খাতে ভিনদেশীদের আগ্রাসন ছাপিয়ে সেবা আর লাভে খামারিদের আস্থার শিখরে উঠে এসেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, করোনার আগে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মুরগির খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজার।
পরবর্তীকালে খাবার ও ওষুধের চড়া দাম, উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে মুরগি বিক্রি, রোগ বালাইয়ে খামারে মড়ক লাগাসহ হরেক কারণে ব্যক্তি পর্যায়ের অধিকাংশ খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কিছু সংখ্যক খামারি দেশী-বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনা (কেজি প্রতি উৎপাদন ফি) করছেন বলেও সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের তথ্য স্মারণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহুজাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা খ্যাতিমান প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালের দিকে দেশে প্রথম চুক্তিভিত্তিক মুরগির খামার শুরু হয়। চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতীয় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এ ব্যবসা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলেও খামারিদের কাছ থেকে জামানত হিসেবে মোটা অংকের অগ্রীম টাকা নেয়াসহ জটিল বিভিন্ন শর্তের কারণে তেমনটা এগুতে পারছিল না এ ব্যবসা। যেসব খামারি শুরু করেছিলেন তারাও মান সম্মত বাচ্চা, সুষম খাবার, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন/ওষুধ সরবরাহ, পরামর্শ সেবার ঘাটতিতে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে করনোর আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পোল্ট্রি খাত।
ডা. হাফিজুর রহমান জানান, করোনা পরবর্তীতে এ খাতের খামারিদের সমস্যা চিহ্নিত করে বিনা জামানতে সহজ শর্তে ‘চুক্তিভিত্তিক খামার’ পরিচালনা শুরু করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস লিমিটেড। কোম্পানিটি তাদের নীতি সহায়তার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই খামারিদের আস্থা অর্জন করেছে। পুরাতন খামারিদের পাশপাশি সারাদেশে শিক্ষিত বেকার যুবরাসহ অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারী পুরুষেরাও নতুন করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে মুরগি উৎপাদনের ব্যবসায় সম্পৃক্ত হচ্ছেন বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ।
কল্পনাতীত উপার্জনে উৎফুল্ল ফিরোজা জানান, ‘আগের কোম্পানির বাচ্চা ৩০ দিনেও ১ কেজি হোত না, কাজী ফার্মসের বাচ্চা ৩৫ দিনে ২ কেজি ছাড়িয়ে যায়। তাদের (কাজী ফার্মস) বাচ্চা ভালো, খাবার ভালো, ফলন ভালো নিয়মিত সপ্তাহে ডাক্তার আসে ২ দিন। এরপরও সমস্যা হলে ফোন করলেই ওষুধ/ ভ্যাকসিনসহ ডাক্তার চলে আসে।’
ফিরোজা বেগম স্বগৌরবে জানান, ‘এখন আমাদের দুর্ভাবনা কেটে গেছে, ছেলেকে ইতালি পাঠিয়েছি। স্বামী নিজেদের জমিতে কৃষি কাজ করেন, ছেলের বৌকে নিয়ে আমি মুরগির খামার সামলাই।’ জেলার সদরের এনায়েতপুরের খামারি রোকোনুজ্জামান। মুরগির খামারের নানা পর্যায়ে অম্ল মধুর অভিজ্ঞতার বর্ণনা শেষে জানালেন, ‘ছয় বছর ধরে ব্রয়লার মুরগি লালন পালন করছি।
প্রথমে দুই বছর নিজের পুঁজিতে লোকসান না হলেও লাভ হয়নি তেমন। পরের দুই বছর বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিক খামার করে যা পাচ্ছিলাম তা আশানারূপ ছিল না। তবে করোনার পর থেকে কাজী ফার্মসের সঙ্গে বিনা পুঁজিতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে ক্রমেই লাভের অংকটা বড় হচ্ছে।’ কাজী ফার্মস লিমিটেডের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, সামর্থ্য বিবেচনায় ঝুঁকি মুক্তভাবে মুরগির খামার সচল রাখতে কাজী ফার্মস কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। উৎপাদন ও বাজার ভালো হলে কোম্পানি ও খামারি উভয়ে লাভবান হবে।
পোল্ট্রি খাবারের দামবৃদ্ধিসহ নানা করণে উৎপাদন খরচ বাড়লে অথবা মুরগির বাজার দর কমলেও খামারির কোনো ক্ষতি নেই। নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত হারে গ্রোয়িং ফি পাচ্ছেন খামারি। তিনি জানান, খামারে কোনো কারণে মুরগি মারা গেলে তার দায়ও নেবে কোম্পানি। কেজিতে সর্বনি¤œ ৬-২৩ টাকা হারেও গ্রোয়িং ফি পাচ্ছেন খামারিরা। খামারে যারা যত বেশি সচেতন ও যতœবান মুনাফাও তারা তত বেশি পান।