দেশে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ধানের তিন মৌসুমে গড়ে প্রায় ১৯ ভাগ জমির ধান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তথা আমদানিকৃত কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কর্তনের আওতায় চলে এসেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে মাত্র ৪.০ শতাংশ জমির ধান যান্ত্রিকভাবে কর্তনের আওতায় ছিল, সরকারের সমন্বিত যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের কর্মকান্ডে সাড়ে তিন বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩-২৪ এ এই পর্যন্ত ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আর এই যান্ত্রিক উড্ডয়নে কষ্টসাধ্য কায়িক শ্রম লাঘব ও সংগ্রহোত্তর পর্বে ফসলহানি কমিয়ে মাত্র ১৫ মাসে ৪টি ফসলের মৌসুম মিলিয়ে কৃষকদের প্রায় ৪ হাজার ৩শ’ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টজন যা মূল প্রকল্পে এ যাবৎ কালের ব্যয়ের থেকে অনেক বেশি। সম্প্রতি সমাপ্ত আমন মৌসুমেই প্রায় ১২৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে তারা জানান।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ের কৃষক ফরিদ উদ্দিন বলেন কম্বাইন হারভেস্টের ভাড়া করায় তার চার বিঘা জমির ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ে খরচ হয়েছে ৬৫০০ টাকা যেখানে আগে ১৩-১৪ হাজার টাকা লাগত। আর একদিনের ভেতর সব হয়ে যাচ্ছে, বোরোর জন্য জমি তৈরি করার সময় বেশি পাওয়া যাচ্ছে। হবিগঞ্জ জেলা কৃষিসম্প্রসারণের উপপরিচালক নুরে আলম সিদ্দিকি বলেন, আমনে প্রায় ৮৮ হাজার ৩১৪ হেক্টর জমির মধ্যে ৫৬ হাজার ২৪০ হেক্টরের ধান যান্ত্রিকভাবে কর্তনের আওতায় এসেছে। কম খরচ, ফসলের সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে অপচয় কম হবার কারণে জেলায় কৃষকদের প্রায় ৪৬ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন সরকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় জেলার কৃষক ও উদ্যোক্তাদের ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে ৪৫২টি কম্বাইন হারভেস্টের প্রদান করা হয়েছে । প্রায় ৭৩ শতাংশ জমির ধান এসব হারভেস্টরের মাধ্যমে কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই করা যাচ্ছে।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কৃষক বখতিয়ার আলি বলেন, তিন বছর আগে নড়ৎড় মৌসুমে বৃষ্টি আর পাড়ারি ঢলের আভাস পাবার পরও ১৫ বিঘা জমির ধান সময়মতো কাটতে পারেন নাই, আশি ভাগের বেশি ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সরকার ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে এলাকায় বেশকিছু কম্বাইন হারভেস্টর দিয়েছে। যন্ত্রগুলো দেওয়ায় কৃষকের অনেক লাভ হয়েছে। এখন প্রতি বিঘা জমিতে ১৬শ টাকায় ধান কাটা ও মাড়াই করে বস্তাভর্তি করে বাড়ি নিয়ে আসতে পারি। আগে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটাতে বিঘা প্রতি নি¤েœ ৫ হাজার টাকা খরচ হতো। আবার মাড়াইয়ে আরও ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন ১৬০০-২০০০ টাকাতেই সব হয়ে যাচ্ছে। ধান নষ্টও হয় অনেক কম, সেখান থেকেও বাড়তি লাভ হয়।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুম মিলিয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ জমির ধান যান্ত্রিকভাবে সংগ্রহের আওতায় আনা হয়েছে। আমন মৌসুমে ১৪, বোরো মৌসুমে ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং আউশে ১৯ শতাংশ কর্তন যন্ত্র দিয়ে করা গেছে। ফলে জাতীয় পর্যায়ে মোট তিন মৌসুমে ২০ লাখ হেক্টর জমির ধান যান্ত্রিকভাবে সংগ্রহের আওতায় এসেছে। কস্ট অফ বেনিফিট এনালাইসিস থেকে দেখা যাচ্ছে কম টাকায় কর্তন ও সংগ্রহত্বর পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কারণে সাশ্রয় হয়েছে গত চার মৌসুমে প্রায় ৪৩০০ টাকা। সময়ের সাশ্রয়ের হিসাবটা ধরতব্যে আনা হয়নি, সেটা আনলে টাকার অঙ্কের পরিমাণ আরো বেশি হবে। মোট ১২ ধরনের ৩৭,৪১৭টি যন্ত্র এই প্রকল্পের আওতায় দিয়েছি এর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টর ৯,৫৪৭, মেইজ শেলার ১,৩৭৬, ৎবধঢ়বৎ ধহফ ৎবধঢ়বৎ নরহফবৎ ৩,২১১। ভুট্টার জমিতে মেইজ শেলারের ব্যবহারের ফলে সাশ্রয় কত সেটা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও কস্ট অফ বেনেফিট এনালাইসিস চলছে, দ্রুত জানাতে পারব। প্রকল্পের আওতায় ২৮ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সারাদেশে ৪০০০ গ্রামীণ মেকানিক তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যারা এই প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। মধ্যাঞ্চলে ২০০ এর উপরে নারীকে যন্ত্রচালনা ও দেখভালের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যারা শত শত নারীকে এই মহাযজ্ঞে উৎসাহিত করে গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিকে বেগবান করছে।
কৃষি অর্থনিতিবিদ অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে কৃষিতে শ্রমিকের প্রাপ্যতা ছিল ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ যা বর্তমানে ৩৬ শতাংশের নিচে এবং শিল্পান্বয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা আরও কমবে বই বাড়বে না। সেজন্য কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া আধুনিক সময়ে কৃষি বিপ্লব সম্ভব নয়।