ঢাকা   বুধবার
০৯ এপ্রিল ২০২৫
২৫ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬

চিংড়িশিল্পে হানা অজ্ঞাত রোগের, বিপর্যয়ে দিশাহারা চাষিরা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ৬ এপ্রিল ২০২৫

চিংড়িশিল্পে হানা অজ্ঞাত রোগের, বিপর্যয়ে দিশাহারা চাষিরা

চিংড়িশিল্প দিয়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই আমিষ বিদেশের বাজারে পাঠিয়ে অর্জন করেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এবার সেই বাণিজ্যে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শ্যামনগরসহ বিভিন্ন উপজেলায় হানা দিয়েছে অজ্ঞাত রোগ। এতে সাদা সোনাখ্যাত মাছ বিক্রির উপযোগী হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে। বছরের শুরুতে এমন বিপর্যয়ে দিশাহারা চাষিরা। 


চিংড়িঘের মালিকরা জানান, নিকট অতীতে এমন বিপর্যয় তারা কখনো দেখিনি। চিংড়িতে বিনিয়োগ এবং লিজ নেওয়া জমির হারি মেটাতে হিমশিম খেতে হবে চাষিদের। অন্যদিকে চিংড়িতে অগ্রিম দাদন দেওয়া ব্যবসায়ীদের দশাও করুণ। বাকি মাসগুলোতে উৎপাদন কম হলে লগ্নি করা অর্থ উঠানোও কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বছরজুড়ে এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ত্রিমুখী (চিংড়িঘের মালিক, জমির লিজদাতা ও চিংড়ি ব্যবসায়ী) সংকটে পড়বে। এ ছাড়া চিংড়িশিল্প থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ আয় হয়, সেখানেও ভাটা পড়বে। যার সার্বিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।


পরিবেশবিদরা বলছেন, দিনদিন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। মাটির গুণগত মান কমছে। সঙ্গে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতির বিরূপ প্রভাবের কারণে এমন দুর্যোগের মুখোমুখি উপকূলীয় এলাকার চিংড়িচাষিরা।


জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সাতক্ষীরায় ছোটবড় মিলিয়ে ৫৯ হাজার লবণপানির ঘের রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। আর জেলার মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় এবং বাকি ১০ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়। তবে এ বছর অধিকাংশ ঘেরেই বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। এতে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 


জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, ভাইরাসের পাশাপাশি প্রচণ্ড দাবদাহ, পর্যাপ্ত পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ঘেরের বাগদা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি, চাকা চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ মরছে। তার ওপর চাষিরা মৎস্য বিভাগের পরামর্শ গ্রহণ না করায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি মৎস্য বিভাগের।


জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম আমার দেশকে বলেন, চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কম। তাই লাভজনক চাষ হচ্ছে না। চাষিদের ক্লাস্টার্স পদ্ধতিতে যেতে হবে। বাগদা চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর লবণসহিষ্ণু মাত্রা সর্বোচ্চ ২৫ পার্টস পার থাউস্যান্ড (পিপিটি)। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি চিংড়ি চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, তা ঘেরগুলোতে নেই। এ কারণে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে গরমের কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। এর পরও মাছ মরার অন্যতম কারণ দুর্বল চিংড়ির পোনা। এ নিয়ে আমরা অভিযান চালিয়ে চিংড়ির হ্যাচারি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছি। 


নূরনগরের মিলন ফিশের মালিক ডি এম মঈনুদ্দীন লাভলু বলেন, বিগত ১০-১২ বছর আগে বিক্রীত চিংড়ি বিক্রির উপযোগী হতে সময় লাগত প্রায় দুই মাস। ৩০টি মাছের ওজন হতো এক কেজি। পর্যায়ক্রমে রেণু পোনার ত্রুটির কারণে এই আকারের মাছ পেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই মাস। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় সাইজের মাছের কদর বেশি। বর্তমানে অপরিণত বয়সে মাছ মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করার মাধ্যমে মাটির স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। 


এ ব্যবসায়ী বলেন, গত কয়েক বছর আগে থাইল্যান্ড থেকে চিংড়ি রেণু আমদানি শুরু হয়। দেখা যায়, ওই দেশের মাছ ঘেরে ছাড়ার পর ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। কিন্তু এই ভাইরাস নির্মূলে একযুগের কাছাকাছি সময়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। আর মৎস্য কর্মকর্তাদের কোনো গবেষণা নেই। তারা জ্ঞান বিতরণ করেন পুঁথিগত বিদ্যার আলোকে। এ কারণে চিংড়ি ব্যবসায়ী ও চিংড়ি চাষিরা এই ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আল্লাহ সহায় আছেন বলেই এত দুর্যোগের পরও আমরা টিকে আছি।


কৈখালীর মেন্দিনগর গ্রামের চিংড়ি ঘেরমালিক রুকনুজ্জামান বাবু বলেন, চলতি বছর আবহাওয়াও উল্টাপাল্টা মনে হচ্ছে। যে কারণে রেণু ছাড়ার পর ২৮-৩০ দিন চিংড়ির বয়স হওয়ার পর হঠাৎ মারা যাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। 


পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও বাপার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সমুদ্রের পানিপ্রবাহ থেকে চিংড়ি চাষ হয়। তাই মাছ মরে যাওয়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাব এবং সমুদ্রের পানিদূষণ থেকে এই বিপর্যয় ঘটতে পারে। এগুলো নিয়ে সরকারের গবেষণা করা উচিত।

এগ্রি২৪.টিভির বিদেশ, জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হতে আগ্রহীরা সিভি  ও নিউজ পাঠান agri24.tv@gmail.com এই ইমেইলে।