ভোলা জেলার সর্ব দক্ষিণের জনপদ চরফ্যাশন উপজেলার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগর উপকূলের মৎস্য আহরণ কেন্দ্র ঢালচর। এ চরে বসবাসরত প্রায় ১৬ হাজার মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে-মাছ শিকার করা। নদী ও সাগরে মাছ ধরে যুগের পর যুগ জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।
ইলিশ মাছ আহরণের পাশাপাশি বছরের ৬ মাস শুটকি ব্যবসা করে থাকেন এখানকার অধিকাংশ মানুষ। তাই এ পেশার সঙ্গে জড়িত ওই উপকূুলের সবাই এখন শুটকি শিল্পে স্বাবলম্বী। এখানকার আহরিত মাছের শুটকি নিয়ে দিনদিন ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে। তাই পুরো উপকূুলীয় এলাকাসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এ শুটকী ব্যবসা। পাশাপাশি ওই এলাকার কাছাকাছি সাগর মোহনার জনপদ- চরপতিলা,কুকরী-মুকরী,চর নিজাম,বয়ার চর,কালকিনি,চর তাজাম্মুল,মনপুরার চর ডেম্পেরিয়াম,হাজির হাট,সাকুচিয়া,পঁচা কোড়ালিয়া, কলাতলী ও চর মোতাহারেও শুটকি তৈরী হয়ে থাকে। তবে ঢালচরের তৈরী শুটকির চাহিদা সর্বত্র সমাদৃত। এ চরের শুটকি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা দিনদিন তাদের ব্যবসায় লাভের মুখ দেখায় তারা খুবই আনন্দিত।
শুটকি ব্যবসায়ীরা জানান,তাদের প্রক্রিয়াজাতকরণ শুটকি এখন ভোলার বাজার ছাড়িয়ে বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী হচ্ছে। শুটকি রপ্তানী করে ৬ মাসে তাদের আয় দশকোটি টাকার উপরে।
মাছ আহরণ,প্রস্তুত,বাজারজাতকরণ ও রপ্তানী কিছুটা কষ্টকর হলেও লোকসানের মুখে কাউকেই পড়তে হয়না। তাই শুটকি শিল্পে খুব অল্পদিনেই ভাগ্যবদল হয় উপকূলবাসীর।
সরেজমিনে দেখা গেছে,সাগর উপকূলের ঢালচরের বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শুটকি পল্লী। সেখানে খোলা আঁকাশের নিচে ছোট ছোট মাছ রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুটকি প্রস্তুত করতে পুরুষদের সহযোগিতা করছেন নারীরাও। এখানে ২ শতাধিক জেলে শুটকি ব্যবসা করে আসছেন। সেখানকার শুটকি ব্যাপারি ফখরুল ইসলাম জানান,আশ্বিন থেকে চৈত্র এ ৬ মাস মূলত: শুটকির মৌসুম। চরজনপদের বেকার অনেক জেলে সাগর থেকে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে এনে রোদ্রে শুকিয়ে তা বিক্রি করে। সেখান থেকে সেগুলো আবার পাইকাররা বিভিন্ন জেলায় চড়া মূল্যে রপ্তানী করেন।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে,এখানকার ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতকরা শুটকি ভোলা,বরিশাল,চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহে পাঠানো হয়ে থাকে।
শুটকি তৈরীকরনের আদ্যপান্ত নিয়ে কথা হয় ওই জনপদের বিভিন্নশ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে ঢালচরের শুটকি পল্লীর জেলে-কালাম মাঝি জানান,পুরো ঢালচরে ২শ’র বেশি জেলে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। যাদের সবাই এখন স¦াবলম্বী। সরকারিভাবে যদি কোন সহযোগিতা পেত তাহলে তারা এ পেশায় আরও অনেক লাভবান হতো।
অপর শুটকি ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মিয়া বলেন,প্রায় দুইযুগধরে এ পেশায় আছি। তিনি বলেন,শুটকি প্রস্তুত করতে তেমন পুঁজির প্রয়োজন হয়না,কারণ এ কাজে শ্রমিকের মজুরী খুবই কম। পরিবারের সবাই সহযোগিতা করলে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভবান হওয়া যায়। এখানকার শুটকি শ্রমিকরা জানান,নদী ও সাগর থেকে রুপচাঁদা,কোঁড়াল,চেউয়া,অলুফা,চিংড়ি,লইট্টা,কাইক্কা,বদর ছুরি,ভোলপোয়া,টোনা,রুঁপসা,জবাকই,বাইম,ও টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ আহরণ করা হয়। সেগুলোকে ৬/৭ দিন রোদে শুকানো হয়। শুকিয়ে তরতাজা হলে বিক্রির উপযোগী হয়। এরপর রপ্তানী করা হয়। তারা জানান,বছরের প্রতি ৬ মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশী শুটকি রপ্তানী হয় শুধু মাত্র ঢালচর থেকেই।
সেখানকার মৎস্য আড়ৎদার মাহাবুব আলম জানান,দক্ষিণ জনপদের সাগর বেষ্টিত ঢালচর শুটকির জন্য বিখ্যাত বলা চলে। বহু বছর থেকে এ অঞ্চলের জেলেরা শুটকি প্রস্তুত ও বিক্রি করে আসছেন।
ঢালচর বাজারের ব্যবসায়ী পরিমল বাবু জানান, কিছু কিছু জেলে আবার সচেতন না থাকায় শুটকি তৈরির নামে নির্বিচারে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নদী থেকে ধরে মেরে ফেলছে । ফলে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে।
এ ব্যাপারে ঢালচর ইউপি সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম হাওলাদার বলেন,শুটকি একটি লাভজনক পেশা। আমাদের এ প্রাচীন ঢালচর দ্বীপের বহু জেলে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে অধিকাংশই স্ব-নির্ভর হয়েছে। সরকার যদি এ বিষয়ে নজরদারী রাখতো তাহলে শুটকি পেশার মাধ্যমে এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ আরো স¦াবলম্বী হতো।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান,সেখানে গত কয়েক বছর থেকে শুটকি ব্যবসা করে ওই চরের বহু মৎস্যজীবী স¦াবলম্বী হয়েছেন। তাদের এ শিল্পকে আরো আধুনিকীকরনের পাশাপাশি কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায়,সে ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা সরকারের কাছে উত্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।