ঢাকা   শুক্রবার
১৮ এপ্রিল ২০২৫
৪ বৈশাখ ১৪৩২, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬

উপকূলে স্বপ্নের হাতছানি: সয়াবিন উৎপাদন হবে ৪০০ কোটি টাকার

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১৬, ২৩ মার্চ ২০২৫

উপকূলে স্বপ্নের হাতছানি: সয়াবিন উৎপাদন হবে ৪০০ কোটি টাকার

‘সয়াল্যান্ড’খ্যাত মেঘনা উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে এখন সয়াবিনের সবুজ পাতায় কৃষকের সোনালি স্বপ্ন দোল খাচ্ছে। ক্ষেতে পাতা, ফুল আর থোকায় থোকায় সয়াবিনে সবুজের সমারোহ। আর দেড়-দুই মাসের মধ্যে ঘরে উঠবে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত এ সোনার ফসল। এ নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন চলছে।

আবহাওয়া ও মাটি উপযোগী হওয়ায় দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ এ জনপদে হয়। চলতি বছর উৎপাদিত সয়াবিন থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ। ফসল ঘরে উঠলে চর ও সংশ্লিষ্ট ওই গ্রামীণ জনপদগুলো অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা থাকে। এদিকে কৃষকদের ভাষ্যমতে, সয়াবিন আবাদে কম পানি প্রয়োজন হয়।

এটি লবণাক্ত জমিতেও হয়। ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদের চেয়ে সয়াবিনে কম খরচ, লাভ বেশি। এতে দিন দিন তাঁরা সয়াবিন চাষে ঝুঁকছেন। সয়াবিন উৎপাদন হবে ৪০০ কোটি টাকারঅন্যদিকে চলতি রবি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়।

জেলার চার উপজেলার ৪৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সবুজ পাতায় দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। অসময়ে বৃষ্টি না হলে এবার প্রত্যেক কৃষকের ঘরে উৎসবের আমেজ থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চরকাচিয়া, চরলক্ষ্মী, চরবাদাম ও চরআলী হাসানের অন্তত ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে মাটিতে বোরো ধানের আবাদ সম্ভব নয়, সেখানে সয়াবিন চাষ করা হয়। এ ছাড়া ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি, সয়াবিনে খরচ কম। অন্যান্য ফসলে আবাদে মাটির শক্তি হ্রাস পায়, সয়াবিন চাষে উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

সয়াবিনের জমিতে অন্যান্য ফসলও ভালো হয়। ধানের চেয়ে সয়াবিনের দাম বেশি। তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় প্রতি মণ সয়াবিন। আবাদ করা জমিতে সর্বোচ্চ দুবার করে সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। তবে ধান চাষে আরো বেশি লাগে। এ ছাড়া আগাছা পরিষ্কারের জন্য গাছের চারা ছোট অবস্থায় একবার নিড়ানি দিলেই হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাঝে মাঝে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় কৃষকদের। এতে জলবায়ু ও লবণাক্ত সহনশীল এবং স্বল্প জীবনকালের সয়াবিনের জাত চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করছে কৃষি বিভাগ।

স্থানীয় কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক হাজার ৬০০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় দুই মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। এতে এবার আবাদ করা ৪৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮৮ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার সবচেয়ে বেশি সয়াবিন উৎপাদন হয় রামগতি ও কমলনগরে। এর মধ্যে রামগতিতে ১৭ হাজার ও কমলনগরে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। এ ছাড়া সদরে সাত হাজার ৫০০ ও রায়পুরে ছয় হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। গত মৌসুমে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার সয়াবিন উৎপাদন হয়। এবার ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি এ জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল।

সদর উপজেলার চররমনীমোহন ইউনিয়নের কৃষক নুর আলম বলেন, ‘সয়াবিন চাষে বীজ বপনের আগে একবার ও গাছে ফুল আসার সময় একবার সার দিতে হয়। এ ছাড়া অবস্থা বুঝে কীটনাশক প্রয়োগ করলেই চলে।’ রায়পুর উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের ফিরোজ আলম বলেন, ‘সয়াবিনের জমিতে পানি সেচ লাগে না। এটি লাভবান হলেও অতিবৃষ্টির ঝুঁকি রয়েছে। ক্ষেতে পানি জমে গেলে সয়াবিন নষ্ট হয়ে যায়। তখন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তবে সয়াবিন চাষ করলে ধানের চেয়ে লাভ বেশি হয়। খরচ ও পরিশ্রম কম।’

রায়পুরের দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আক্তার হোসেন বলেন, ‘কৃষক সয়াবিন ঘরে তুলতে আরো দেড়-দুই মাসের মতো সময় লাগবে। এখন বৃষ্টি হলে ফসলের জন্য ভালো হতো। কীটনাশক প্রয়োগে কিছু কৃষক পরামর্শ না শোনায় তাঁদের ক্ষেতের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘সয়াবিন ঘিরে এখানে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ঋণ দেয়। চরের মানুষের জীবনমান বদলে যাচ্ছে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ জেলায় পরিকল্পিতভাবে সয়াবিননির্ভর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি। এ জন্য প্রশাসনও যেন উদাসীন।’

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন, ‘উপকূলীয় জমিতে লবণ রয়েছে। অন্য ফসল লবণাক্ততা সহ্য করতে না পারলেও সয়াবিন তা পারে। তবে বেশি লবণাক্ত জমি যেকোনো ফসলের জন্য ক্ষতি। আমরা কৃষকদের সয়াবিনের উন্নত জাত সরবরাহ করি। বিনা ৫, বিনা ৬, বারি ৪, বারি ৬, বিইউ ৩, বিইউ ৪, বিইউ ৫—এসব জাতের সয়াবিনের দানা বড়, ওজন বেশি। তাই ফলনও বেশি।’

সর্বশেষ