
খাগড়াছড়ি তামাক চাষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা। এ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ফসলি জমি, মাইনী নদীর তীরের উর্বর ক্ষেত, বাড়ির আঙ্গিনা; এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেও হচ্ছে ক্ষতিকর তামাক চাষ।
একদিকে কৃষি বিভাগ তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার দাবি করলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। এতে করে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের আশংকা দেখা দিয়েছে। যে জমিতে আগে চাষাবাদ হতো শাক-সবজি, আলু, ধান, ভুূট্টাসহ নানা ফসলের। সে উর্বর জমি এখন তামাক চাষের দখলে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার মাইনীর অববাহিকার অধিকাংশ উর্বর জমিই এখন তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসনের শিকার। নিরুৎসাহিত করতে কোন ধরনের উদ্যোগ না থাকায় দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো তামাক চাষে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করেই দিন-দিন বাড়ছে তামাকের চাষ। এতে মাইনী নদীর দু'তীরবর্তী ফসলী জমির প্রায় পুরোটাই এখন তামাকের দখলে। আর এ সব কারণে চাষীরা তামাক চাষে বেশি করে ঝুঁকছে ।
সরেজমিনে দেখা গেছে দীঘিনালা উপজেলার চারিদিকে তামাক আর তামাক। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশেও তামাকের দখলে। বিশেষ করে মাইনী নদীর তীরবর্তী উর্বর ফসলি জমিতে প্রতি বছরের মতো এবারও শাক-সবজির বদলে চাষবাদ করা হয়েছে ক্ষতিকর তামাক। শুধু তাই নয়, দীঘিনালা হাসিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দীঘিনালা কুজেন্দ্র-মল্লিকা কলেজের পাশেও তামাক চাষ করা হয়েছে। এতে করে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। অথচ এক সময় এসব জমিতে আলু, কফি, টমেটোসহ বিভিন্ন শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল ।
কৃষি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর বন্যার কারণে মাঈনী নদীর দু'তীরবর্তী ফসলী জমিতে পলি জমে। তাই, এসব জমিতে ফসল উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। আর এ কারণেই তামাক কোম্পানি এ অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে শুধুমাত্র খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলায় এ বছর ৪৭১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে । এবছর ৪/৫ শত জন চাষী প্রায় ১হাজার ২০০ একর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। তামাক শুকাতে পুরো উপজেলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৫শতাধিক চুল্লী। চুল্লীগুলাতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ।
স্থানীয় কৃষক রবি শংকর চাকমা, সোনা রতন চাকমা ও আব্দুল আলীম বলেন তামাক চাষে কৃষকদের অগ্রীম লোনের পাশাপাশি সার বীজ কীটনাশক এবং উপাদন করার পর তামাক কোম্পানিরা তা আবার কিনে নেয়। তাই আমরা তামাক পাতা সহজে বিক্রি করতে পারি। অপরদিকে অন্যান্য কৃষি ফসল যেমন ভুট্টা আখ, সূর্যমূখী ফুল, আলুসহ অন্যান শাক সবজি চাষাবাদ করলে বিক্রির নিশ্চয়তা না থাকায় ফসলের উৎপাদন করেও ন্যায্য দাম মিলে না। অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলো সার ও অগ্রিম অর্থ দেয়ায় কৃষকরা তামাক চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন বলে তারা জানান।
কুজেন্দ্র মল্লিকা মর্ডান কলেজের অধ্যক্ষ, সাধন ত্রিপুরা ও হাসিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকলিমা খাতুন জানান দীঘিনালা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ফসলি জমি, স্কুল, কলেজ মাইনী নদীর তীর এমন কি বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষতিকর তামাক চাষ। মাঈনী নদীর দু'তীরবর্তী ফসলী জমিতে পলি জমায় এসব জমিতে ফসল উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। আর এ কারনেই তামাক কোম্পানি এ অঞ্চলকে তামাক চাষের জন্য বেছে নিয়েছে।
হাসিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকলিমা আক্তার আরো জানান,আমরা মা সমাবেশের মাধ্যমে তামাকের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে অভিভাবকদের তুলে ধরি এবং তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করি, তার পরও যাদের জমি তারা তামাক চাষ অব্যাহত রাখছে । একই ভাবে কুজেন্দ্র মল্লিকা মর্ডান কলেজের অধ্যক্ষ সাধন ত্রিপুরা জানান, কলেজের পক্ষ থেকে একাধিক বার নিষেধ করার পরও যাদের জমি তারা কলেজের পাশেই তামাক চাষ করছে।
অপরদিকে সচেতন মহলের দাবি তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করনে সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থার কার্যক্রম তেমন চোখে পড়েনি। সেকারনে তামাকের বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের সাড়া পড়ছেনা।
দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার তনয় তালুকদার বলেন, তামাক চাষ স্বাস্থ্যরজন্য অব্যশই ক্ষতিকর। তামাক চাষীদের দীর্ঘ মেয়াদি রোগ দেখা দিতে পারে । যার ফলে তামাক চাষীদের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হজম শক্তি কমে যায় এছাড়া নানা ধরনের রোগ হতে পারে। এসব রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য তামাক চাষ ছেড়ে দিতে হবে এবং তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সর্ম্পেকে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
এদিকে কৃষি বিভাগ তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার কথা বললেও মাঠে তার কোন প্রভাব নেই। উল্টো গত বছরের তুলনায় এ বছর তামাক চাষের পরিধি আরো বেড়েছে। বিগত সময়ের চেয়ে এবার তামাক চাষ বেড়েছে বলছেন দীঘিনালার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: শাহাদাত হোসেন। তিনি জানান কৃষিপণ্যের সঠিক দাম না পাওয়া এবং তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করায় কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।
তিনি আরো বলেন, তামাকের বিকল্প হিসেবে যে ফসল আমরা বিগত বছরগুলোতে কৃষকদের দিয়ে চাষ করানোর চেষ্টা করেছি, দেখা গেছে সঠিক বিপণন ব্যবস্তা না থাকার কারণে সে সব ফসলের সঠিক দাম তারা পায়নি। এতে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া দীঘিনালা উপজেলায় তামাক চাষে আরেকটা নতুন কোম্পানি কাজ করছে। এসব কারণে তামাক কোম্পানি গুলোতে প্রতিযোগিতার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি উচ্চমূল্যের ফসল যেমন মসলা জাতীয় ফসল, ভুট্টা, সূর্যমুখী, সরিষা চাষাবাদে উৎসাহিত করে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে।
অপরদিকে পার্বত্য এ জনপদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আইন করে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করেন এখানকার পরিবেশ সচেতন মহল।
এগ্রি২৪.টিভির বিদেশ, জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হতে আগ্রহীরা সিভি ও নিউজ পাঠান agri24.tv@gmail.com এই ইমেইলে।