ঢাকা   শুক্রবার
৩১ জানুয়ারি ২০২৫
১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩০ রজব ১৪৪৬

অচল পায়ে আক্কাছের কৃষি সাফল্য

শাইখ সিরাজ

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

অচল পায়ে আক্কাছের কৃষি সাফল্য

মাগুরা সদর উপজেলার নালিয়ারডাঙা গ্রামের আক্কাছ একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে সাত বছর বয়সে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কিন্তু শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমাতে পারেনি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে।

ফলে অচল পা নিয়েই তিনি অতিক্রম করে চলছেন ফসলের মাঠের পর মাঠ। কৃষিকে আঁকড়ে ধরে তৈরি করেছেন নিজের সাফল্যের পথ। ক্রাচে ভর দিয়েই জমির বুকে ফলাচ্ছেন সোনালি ফসল। কৃষক আক্কাছ কখনো নির্ধারিত একটি ফসল উৎপাদনে থেমে থাকেননি; বৈচিত্র্যময় ফল-ফসল উৎপাদনে আগ্রহ তাঁর।

তিনি চাষ করছেন সুপার ফুড চিয়া সিডসহ নানা ধরনের ফল-ফসল। শীতের এক দুপুরে তাঁর চিয়া সিড ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। দেখা গেল সবেমাত্র গাছগুলোতে ফুল আসতে শুরু করেছে। মৃদু বাতাস সবুজ গাছগুলোতে দোল দিয়ে যেন আক্কাছের সাফল্যের বারতা জানান দিচ্ছে।

বর্তমান সময়ে চিয়া সিড দারুণ অর্থকরী একটি ফসল। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে চিয়া সিডের কদরও বেড়েছে। বিশেষ করে করোনার পর অনেকে বিশেষভাবে স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠেছেন। এই মানুষদের কাছে চিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপকরণ। চিয়া হচ্ছে সালভিয়া হিসপানিকা নামের মিন্ট প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ।

এটি মূলত মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকোর মরুভূমি অঞ্চলে বেশি জন্মায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাচীন অ্যাজটেক জাতির খাদ্যতালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেখতে অনেকটা তোকমাদানার মতো। সাদা ও কালো রঙের এবং তিলের মতো ছোট আকারের। সাধারণত বীজজাতীয় যেকোনো খাবারই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পুষ্টিবিদদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এতে আছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসহ নানা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্য আঁশ। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, ফসল হিসেবেও বেশ অর্থকরী। আক্কাছ জানালেন, ৪০ শতক জমিতে চিয়া সিড চাষ করতে রোপণ থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত তিন মাসে খরচ হয় সাকল্যে সাত হাজার টাকা। এই পরিমাণ জমি থেকে ছয় থেকে সাত মণ চিয়া সিড উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজি এক হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।
এ ছাড়া আক্কাছ চাষ করেছেন মাষকলাই, পেঁয়াজ, সরিষা থেকে শুরু করে নানা মৌসুমি সবজি। সেইসব দেখতে দেখতে কথা হয় তাঁর বাবা আওয়াল খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পঙ্গু ছেলে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে যাবে ভেবে বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ছেলে বোঝা হয়ে থাকেনি। উল্টো অচল পা নিয়েই সে পরিবারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছে।’ শুধু পরিবার নয়, সমাজেরও দায়িত্ব নিয়েছেন আক্কাছ খান। কৃষকদের বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মাঠের পাশে তৈরি করেছেন ছাউনি। বসিয়েছেন টিউবওয়েল। মাঠে কাজ করতে করতে ক্লান্ত কৃষক যেন দুদণ্ড বিশ্রাম নিয়ে পানি পান করতে পারে। ওই ছাউনির নিচে বসে কথা হলো এলাকার অনেকের সঙ্গে। বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন কৃষক বললেন, আক্কাছ শুধু তাঁর পরিবারের নয়, পুরো এলাকার গর্ব। তাঁর সাফল্যে উজ্জ্বল হয়েছে গ্রামের নাম।

আক্কাছ বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হলেও কোনো কাজকেই আমি ছোট মনে করি না। নিজের মনোবল ঠিক রেখে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমার কাজ দেখে এলাকার মানুষ উৎসাহ দেয়। তাদের ভালোবাসা নিয়েই আমার বেঁচে থাকাটা সুন্দর হয়ে উঠেছে। আমি আইপিএমের সেরা কৃষক, মসলা চাষে সেরা কৃষক এবং মাগুরার মডেল কৃষকের পুরস্কার অর্জন করেছি কৃষি বিভাগ থেকে।’

কৃষি সাফল্যের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টিকারী এই উদ্যোক্তা অন্য কৃষকের কথাও ভাবেন। ভাবেন কৃষকের প্রশান্তির কথাও। আক্কাছ স্বপ্ন দেখেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে কিছু করার।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কৃষিতে আক্কাছ যে সাফল্যের নজির গড়েছেন, তা সবার জন্য অনুপ্রেরণার; বিশেষ করে আজকের তরুণ-তরুণীরা তাঁদের উপলব্ধিতে নিতে পারেন আক্কাছের কৃষির অনন্য শক্তি। চাকরির পেছনে ছুটে সময় অপচয় না করে সেই সময়টুকু কৃষিতে বিনিয়োগ হতে পারে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ।